বড়োদের প্রণাম ও ছোটোদের ভালোবাসা জানাই । প্রথম যখন আমাদের ফোন আসে তখন আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম, যে মহিলা পুরোহিতও হওয়া যায়! সবার মনে একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন এসেছিল। কিন্তু মনের মধ্যে আনন্দও হয়েছিল যে আমরাও সকলে পুজো করতে পারব । সমস্ত ধরনের পৌরোহিত্যের কাজ আমরা করবো। ১০ তারিখে আমরা সকলে পাকুয়া ভারত সেবাশ্রমে এসেছিলাম তখন আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না, জানতাম না। অন্য এক পরিবেশ খোলা মাঠের মধ্যে ধানখেতের ভেতর দিয়ে আমাদের সেই আশ্রমে যেতে হয়েছিল । প্রথম দিন যখন আমরা প্রথম ক্লাসে বসি তখন আমাদের সকলের মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল। আমাদের যিনি গুরুজী ছিলেন তিনি শ্রীকমলানন্দ পুরী তিনি আমাদের প্রথম ক্লাসে যেসব করিয়ে ছিলেন সেগুলি হল – আমাদের দীক্ষা পৈতা দিলেন, আচার, বিচার, কুলাচার, সদাচার ও সংস্কার সম্বন্ধে আমাদের বোঝালেন। তারপর ক্লাস শেষে আমরা সকলে মধ্যাহ্ন ভোজন করে এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিশ্রাম করেছিলাম। এখানকার রাঁধুনী মাসিরা ছিলেন খুব সুন্দর। তাঁরা খুব সুন্দর সুস্বাদু রান্না করতেন তারপর সন্ধ্যায় আমার সকলে সন্ধ্যারতি দেখলাম এবং জানলাম কী ভাবে কোনটার পর কোনটা আরতি করতে হবে। এই আশ্রমে যিনি গুরুদেব তাঁকে অস্ত্র দিয়ে আরতি করা হয়। সেই দিন অস্ত্র আরতি দেখে আমাদেরও মনের মধ্যে আশা জেগেছিল যে আমরা অস্ত্র আরতি করবো। এই ভাবে আমাদের প্রথম দিন খুব আনন্দের সঙ্গে কাটলো এবং সকলের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারপর পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে শাড়ি পরে পূজার ঘরে পূজার সামগ্রী গুছিয়ে ঘর পরিষ্কার করে সকলে আসন পেতে সবাই নিজের নিজের আসনে বসতাম। তারপর সকলে তিলক পরতাম। আমরা প্রথম পঞ্চদেবতার পুজো শিখেছি। তারপর নারায়ণ পুজো, লক্ষ্মী পুজো, সরস্বতী পুজো, গণেশ পুজো, হোম কীভাবে করতে হয়, হোম কত প্রকারের হয়, হোম করলে কী কী ফললাভ হয়, কোন বীজমন্ত্র পড়লে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও সংসারে কী কী উন্নতি হবে; যজমানের বাড়িতে কীভাবে পুজো করতে হবে এই সব পদ্ধতি আমাদের গুরুজিরা শিক্ষা দিয়েছিলেন।

পঞ্জিকা কী, কীভাবে দেখতে হয় — এ বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না, কিন্তু আমাদের সকলের প্রিয় পীযূষ কাকু (তিনি নিজেই অনলাইন বাংলা পঞ্জিকা তৈরি করেছেন) উনি আমাদের যেভাবে বাড়িতে বসে অনলাইন প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস নিয়েছিলেন যে পঞ্জিকা বুঝতে কারো আর কোনো অসুবিধাই নেই। এখন সবাই পঞ্জিকা দেখতে পারি।
এই ভাবে আমাদের বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো এবং সকলেরই সাথে খুব সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমরা সকলে একান্নবর্তী পরিবারের মতোই থাকতাম। আমাদের পৌরোহিত্যের প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতর ক্লাস চলত। আমাদের সংস্কৃত শিক্ষিকা শ্রীমতী তাপসী মণ্ডল মহাশয়া আমাদের খেলার ছলে গানের ছলে সংস্কৃত শব্দ মুখে এনে দিয়েছেন। যখন আমরা সংস্কৃত ক্লাস করতাম তখন আমাদের সেই ছোট্ট বেলার কথা অর্থাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল। প্রাইমারি স্কুলে আমরা যেমন করে পড়াশুনা করতাম ঠিক তেমনি এখানেও মাটিতে বসে আমরা আর দিদিমণি যেমন ভাবে ক্লাস নিতেন তেমনি এখানে আমাদের শিক্ষিকা সংস্কৃত শেখাতেন। আমরা সকলে আনন্দের সঙ্গে সংস্কৃত শিখে ছোট ছোট বাক্য বানিয়ে সংস্কৃত ভাষাতে কথা বলতে পারছি এবং পুজোর বেশ কিছু মন্ত্র আমরা উচ্চারণ করতে পারছি। আগে তো আমরা সংস্কৃত উচ্চারণ করতেই পারতাম না। শিক্ষিকা এমন ভাবে এত সুন্দর করে শিখিয়েছেন যে আমরা মাত্র দশ দিনে সংস্কৃতে কথা বলা, মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারছিলাম সকলেই। এখানে প্রতি দিন ১২ থেকে ২ পর্যন্ত সংস্কৃত ক্লাস হত।
এখানে আরও তিনজন গুরুজি এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন আমাদের বিয়ে দেওয়া শিখিয়েছেন । তিনি হলেন শ্রী শুভঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি আমাদের খুব সুন্দর ভাবে পর পর পদ্ধতিগুলি দেখিয়েছেন। আরও দুজন ছিলেন তাঁরা হলেন আমাদের পরীক্ষক শ্রী শ্যামল মৈত্র ও সৌগত ভট্টাচার্য । এঁরা আমাদের পরীক্ষা নেবার পাশাপাশি পূজার পদ্ধতি শেখাচ্ছিলেন।

আমরা যে সমস্ত মেয়েরা এখানে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি আমরা সকলেই আগে জানতাম না যে এখানে মহিলা ব্রাহ্মণ শিক্ষার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে । আমরা এখানে আসে লক্ষ্য স্থির করেছি যে নারী শক্তির জাগরণ করানো । নারীরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই, নারীরা সব পারে। নারীরা তো মায়ের রূপ দশভুজা। এখন মেয়েরা তো সমস্ত ধরনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাহলে অব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে কেন ব্রাহ্মণের কাজ করতে পারবে না? আমরা যখন প্রথম পৈতা ধারণ করি তখন আমাদের মনের মধ্যে অন্য ধরনের অনুভূতি হচ্ছিলো । তাই আমরা সমস্ত মেয়ে এটাই লক্ষ্য করেছি যে সমাজের বুকে আমরা মহিলা পুরোহিত নামে পরিচিত হবো এবং আমরা আরও মহিলা ও মেয়েদের একত্র করে সমাজের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বো।
আমাদের সকলের এখানে এসে খুবই ভালো লেগেছে। এখানকার পরিবেশ এত সুন্দর যে বলার কোনো ভাষা নেই। এই শিবিরে যাঁরা পরিচালনা করেছেন তাঁরাও খুব ভালো আমরা সকলে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই যে আমাদের এত সুন্দর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।প্রত্যেক গুরুজী, শিক্ষিকা, এবং হিন্দু সঙ্ঘের প্রত্যেক জনকে আমরা কৃতজ্ঞতা ও প্রণাম জানিয়ে আমাদের এই অনুভব কথা এখানেই সমাপ্ত করছি।
সকলকে আমদের তরফ থেকে ধন্যবাদ
টুম্পা রানী মণ্ডল